Monday, May 21, 2018

★সাধক রামপ্রসাদ সেন ★


কলকাতা শহরের ২৫ মাইল উত্তরে হুগলি
নদীর তীরে অবস্থিত হালিশহর গ্রামে
১৭১৮ সালে। এক তান্ত্রিক বৈদ্য
পরিবারে রামপ্রসাদ সেনের জন্ম।
রামপ্রসাদ সেন এর প্রকৃত জন্মের
তারিখটি জানা যায় নাই। তবে বিভিন্ন
তথ্যপ্রমাণ বিশ্লেষণ করে পাওয় যায়
রামপ্রসাদ সেন এর জন্ম তারিখ।
রামপ্রসাদের পিতা রামরাম সেন
ছিলেন একজন আয়ুর্বৈদিক চিকিৎসক ও
সংস্কৃত পণ্ডিত। রামপ্রসাদের মা
সিদ্ধেশ্বরী দেবী ছিলেন রামরাম
সেনের দ্বিতীয়া পত্নী। সেকালের
রীতি অনুযায়ী বাল্যকালে
রামপ্রসাদকে একটি সংস্কৃত টোলে
শিক্ষালাভের জন্য প্রেরণ করা হয়।
সেখানে তিনি সংস্কৃত ব্যাকরণ সাহিত্য
ফার্সি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা লাভ
করেন। ছেলেবেলা থেকেই কাব্যরচনা
এবং নতুন ভাষাশিক্ষায় তাঁর আগ্রহ ছিল
প্রবল।রামরাম সেন চেয়েছিলেন পুত্র
রামপ্রসাদ সেন পারিবারিক চিকিৎসক
বৃত্তি গ্রহণ করুক। কিন্তু রামপ্রসাদের
সেদিকে আগ্রহ ছিল না। রামপ্রসাদ সেন
আগ্রহ ছিল আধ্যাত্মিক জীবনযাপন এবং
সুখীও ছিলেন। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে তাঁর
পরিবারবর্গ সর্বাণী নামে এক বালিকার
সঙ্গে বাইশ বছর বয়সী রামপ্রসাদের
বিবাহ দেন। বিবাহের পর পারিবারিক
প্রথানুযায়ী নবদম্পতি কুলগুরু
মাধবাচার্যের নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন।
কথিত আছে দীক্ষাগ্রহণকালে গুরু তাঁর
কানে মন্ত্রপ্রদান করলে তিনি দেবী
কালীর অনুরক্ত হয়ে পড়েন। এক বছর পর
তাঁর গুরুর মৃত্যু হয়। এরপর রামপ্রসাদ
তান্ত্রিক যোগী ও পণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ
আগমবাগীশের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছিলেন বঙ্গদেশে
কালী আরাধনার প্রবর্তক এবং সুপ্রসিদ্ধ
শাক্ত তন্ত্রগ্রন্থ তন্ত্রসারের রচয়িতা।
আগমবাগীশ রামপ্রসাদকে তন্ত্রসাধনা ও
কালীপূজার পদ্ধতি শিক্ষা দেন।
রামপ্রসাদের পিতামাতা চাইতেন
উপার্জন ক্ষমতা আর্জন করুক কিন্তু
রামপ্রসাদ অধিকাংশ সময়ই সাধনায়
অতিবাহিত করতেন। এমতাবস্থায় রামরাম
সেনের মৃত্যু বরন করেন তখন দারিদ্র্যের
বশবর্তী হয়ে রামপ্রসাদকে বিষয়কর্মে
প্রবৃত্ত হতে হয়। কলকাতায় এসে দুর্গাচরণ
মিত্র নামে এক ধনীর কাছারিতে
মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে কেরানির
কাজ শুরু করেন তিনি। কথিত আছে
কাছারির হিসাবের খাতায় সদ্যরচিত
শ্যামাসঙ্গীত লিখতে শুরু করলে অন্যান্য
কর্মচারীরা তাঁদের মালিকের নিকট
রামপ্রসাদের বিরুদ্ধে নালিশ জানান।
কিন্তু দুর্গাচরণ মিত্র গানগুলি পড়ে
রামপ্রসাদের কবিত্বশক্তিতে মুগ্ধ হয়ে
যান।দুর্গাচরণ মিত্র কবি রামপ্রসাদকে
কেরানির কাজ থেকে অব্যহতি দিয়ে
স্বগ্রামে প্রেরণ করেন এবং তাঁর মাসিক
ভাতার ব্যবস্থা করেন। গ্রামে ফিরে
রামপ্রসাদ কঠোর সাধনায় মগ্ন হন। জানা
যায় এই সময় তিনি আকণ্ঠ গঙ্গাজলে
নিমজ্জিত অবস্থায় শ্যামাসঙ্গীত
গাইতেন। তান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী
তন্ত্রসাধনার আদর্শ পবিত্র এক পঞ্চবটীর
বট বেল আমলকি অশোক ও অশ্বত্থ গাছের
সম্মিলিত রূপ তলায় পঞ্চমুণ্ডীর আসনে
সাপ ব্যাঙ খরগোশ শৃগাল ও মানুষের
করোটীর দ্বারা সৃষ্ট আসন বসে তিনি
ধ্যান ও সাধনা করতেন। লোকবিশ্বাস
দেবী কালী আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে
তাঁকে দর্শন দিয়েছিলেন।নদিয়ার
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায় রামপ্রসাদের গান
শুনে মুগ্ধ হন। তিনি নিজেও ছিলেন
কালীভক্ত। তাই রামপ্রসাদকে তিনি
সভাকবির মর্যাদা দেন। রামপ্রসাদ অবশ্য
মহারাজের রাজসভায় বিশেষ আসতেন
না। তিনি তন্ত্রসাধনা ও কালীপূজাতেই
অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করতেন।
কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে ১০০ একর নিষ্কর জমি
প্রদান করেন। এর প্রতিদানে রামপ্রসাদ
তাঁর বিদ্যাসুন্দর কাব্য কৃষ্ণচন্দ্রকে উৎসর্গ
করেন। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রামপ্রসাদকে
কবিরঞ্জন উপাধিও প্রদান করেছিলেন।
মহারাজের অন্তিম সময়ে রামপ্রসাদ তাঁর
পাশে থেকে তাঁকে কালীর নামগান
শুনিয়েছিলেন। আরও জানা যায় নবাব
সিরাজদ্দৌলা ও সুফি সন্তেরাও
রামপ্রসাদের আধ্যাত্মিক সংগীতে মুগ্ধ
হন। নবাবের অনুরোধে রামপ্রসাদ একবার
তাঁর সভাতেও গিয়েছিলেন। বাংলার
ঘরে ঘরে রামপ্রসাদ সম্পর্কিত নানান
কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এগুলির মধ্যে
রামপ্রসাদের বেড়া বাঁধার গল্পটি বেশ
জনপ্রিয়। এই কাহিনি অনুসারে কালী
রামপ্রসাদের কন্যা জগদীশ্বরীর রূপে
এসে কবিকে ঘরের ভাঙা বেড়া বাঁধতে
সাহায্য করেছিলেন। রামপ্রসাদ পরে
বুঝতে পারেন যে তাঁর ইষ্টদেবীই কন্যার
বেশে এসে তাঁকে সাহায্য করেন।
আরেকটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি হল
বারাণসী যাত্রাকালে রামপ্রসাদের
দেবী অন্নপূর্ণার দর্শন লাভ। একবার
তিনি গঙ্গাস্নান সেরে নিত্যপূজার
কাজে চলেছেন এমন সময় একটি সুন্দরী
মেয়ে রামপ্রসাদের কাছে গান শোনার
আবদার ধরে। পূজার দেরি হয়ে যাচ্ছে
দেখে রামপ্রসাদ মেয়েটিকে একটু
অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু পরে ফিরে
এসে তাকে আর দেখতে পান না। পরে
তিনি ধ্যানে এক দিব্যজ্যোতি দর্শন
করেন এবং দেবীর কণ্ঠস্বর শোনেন আমি
অন্নপূর্ণা । আমি বারাণসী থেকে তোর
গান শুনতে এসেছিলাম। কিন্তু হতাশ হয়ে
ফিরে যাচ্ছি। রামপ্রসাদ নিজের উপর
ক্রুদ্ধ হন। তখনই দেবী অন্নপূর্ণাকে গান
শোনাবার মানসে কাশীধামের
উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু ত্রিবেণী
সংগমে এসে তাঁর পুনরায় দিব্যজ্যোতি
দর্শন হয়। দেবীর কণ্ঠে তিনি শুনতে পান
এখানেই আমাকে গান শোনা।
বারাণসীই আমার একমাত্র নিবাস নয়
আমি সমগ্র জগৎ চরাচরে অবস্থান করি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলার ভক্তি
আন্দোলনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব
হলেন রামপ্রসাদ সেন। তিনিই বাংলায়
ভক্তিবাদী শাক্তধর্ম ও দেবী কালীর
লীলাকীর্তন শ্যামাসংগীতের
ধারাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন।
রামপ্রসাদ সেনই প্রথম কবি যিনি এই
প্রকার গভীর ভক্তিসহকারে দেবী কালীর
লীলাকীর্তন গান রচনা করেন। তাঁর
গানেই প্রথম কালীকে স্নেহময়ী মাতা
এমনকি ছোটো মেয়ের রূপেও দেখা যায়।
তাঁর পরে একাধিক শাক্ত কবি এই
কালীভক্তি প্রথাটিকে উজ্জীবিত করে
রাখেন। কীর্তন বাংলার লোকসঙ্গীত
বাউল গানের সঙ্গে ভারতীয় শাস্ত্রীয়
সঙ্গীতের সুরের মিশ্রণে রামপ্রসাদ
বাংলা সংগীতে এক নতুন সুর সৃষ্টি করেন।
পরবর্তী দেড়শো বছরে শতাধিক কবি
সংগীতকার এই সুরে গান রচনা
করেছিলেন। তাঁর কাব্য ছিল মধুর যদিও এই
সব গান লোকসুরের বদলে শাস্ত্রীয়
ধারায় গাওয়ারই রীতি প্রচলিত ছিল।
একই ধারায় সংগীতরচনাকারী তাঁর দুই
বিশিষ্ট উত্তরসূরি হলেন কমলাকান্ত ও
মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। রামপ্রসাদের
গান রামপ্রসাদী নামে পরিচিত।
তৎকালীন বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
আর্থিক দুরবস্থা ও গ্রামীণ সংস্কৃতির
অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে এই কালীভক্তি
আন্দোলনের উদ্ভব হয়। তাঁর গানেও এই
সকল ঘটনার প্রভাব সুস্পষ্ট। এই কারণে
তাঁর জীবদ্দশাতেই গানগুলি ব্যাপক
জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।রামপ্রসাদের
রচনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য
বিদ্যাসুন্দর বা কালিকামঙ্গল অষ্টাদশ
শতাব্দীর ষষ্ঠ অথবা সপ্তম দশক
কালীকীর্তন কৃষ্ণকীর্তন নামক অসম্পূর্ণ
খণ্ডকাব্য ও শক্তিগীতি। কালীকীর্তন
গ্রন্থে গীতিকবিতা ও আখ্যানমূলক
কবিতার মাধ্যমে উমার জীবনকাহিনি
বর্ণিত হয়েছে। কৃষ্ণকীর্তন অসম্পূর্ণ রচনা।
এই গ্রন্থে গান ও কবিতার মাধ্যমে
কৃষ্ণের জীবনকথা বর্ণিত হয়েছে। এর
সম্পূর্ণ অংশটি পাওয়া যায় না।
বিদ্যাসুন্দর রাজকুমারী বিদ্যা ও
রাজকুমার সুন্দরের বহুপ্রচলিত প্রেম ও
পরিণয়কাহিনি অবলম্বনে রচিত। সেই
যুগে এই কাহিনিটি বাংলায় খুবই
জনপ্রিয় ছিল। রামপ্রসাদ লিখেছেন
বিদ্যা ও সুন্দরে প্রেম ও পরিণয় দেবী
কালীর সহায়তায় ঘটেছিল। শক্তিগীতি
রামপ্রসাদের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য
ও প্রসিদ্ধতম রচনা। এই গানগুলির মধ্যে
দেবী কালীর প্রতি তাঁর গভীর প্রেম ও
শ্রদ্ধাবোধ প্রস্ফুটিত হয়েছে।
শক্তিগীতির গানগুলির কালীর সঙ্গে
কবির সম্পর্ক মা ও সন্তানের সম্পর্ক।
এখানে দেবীর মনুষ্যসন্তান কবি তাঁর
মায়ের সঙ্গে ভাবভালবাসা এমনকি
কোথাও কলহ পর্যন্ত করেছেন।ঊনবিংশ
শতাব্দীর বিশিষ্ট বাঙালি ধর্মগুরু
রামকৃষ্ণ পরমহংস প্রায়শই রামপ্রসাদী
গান গাইতেন। রামপ্রসাদ ছিলেন তাঁর
প্রিয় কবি। তাঁর গাওয়া রামপ্রসাদীগুলি
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত গ্রন্থে মুদ্রিত
হয়েছে। এই গ্রন্থে লেখা আছে.তিনি
রামকৃষ্ণ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অতিবাহিত
করতেন কমলাকান্ত ও রামপ্রসাদের
লেখা দিব্যজননীর লীলাসঙ্গীত গেয়ে।
এই আনন্দময় গানগুলি ঈশ্বরের প্রত্যক্ষ
ভাবের বর্ণনাকারী রামকৃষ্ণ পরমহংস
যোগানন্দও রামপ্রসাদ ও তাঁর
ভক্তিগীতির গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনিও
প্রায়ই এই গানগুলি গাইতেন।ভগিনী
নিবেদিতা রামপ্রসাদ সেনের সঙ্গে
ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের তুলনা
করেন। বৃদ্ধ বয়সে রামপ্রসাদের
দেখাশোনা করতেন তাঁর পুত্র রামদুলাল
ও পুত্রবধূ ভগবতী। রামপ্রসাদের মৃত্যু নিয়ে
একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে।
রামপ্রসাদ প্রতি বছর দীপান্বিতা
অমাবস্যায় কালীপূজা করতেন। একবার
সারারাত পূজা ও গানের পর সকালে
কালীপ্রতিমা মাথায় করে নিয়ে
বিসর্জনের পথে বের হন রামপ্রসাদ।
ভক্তগণ তাঁর পিছন বিসর্জন
শোভাযাত্রায় অংশ নেন। স্বরচিত
শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে গঙ্গার
জলে প্রতিমা বিসর্জনার্থে অবগাহন
করেন রামপ্রসাদ। প্রতিমা বিসর্জনের
সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর প্রাণ বহির্গত হয় ১৭৭৫
সালে।

No comments:

Post a Comment